সাতক্ষীরায় ক্রমশঃ বাড়ছে মিঠাপানির মাছের ঘেরে বোরো ধানের চাষ। শীত মৌসুমের শুরুতে জেলার অভ্যন্তরের মিঠা পানির মাছের ঘেরে বোরো ধানের চাষ করছেন কৃষকরা। মাছের ঘেরে বোরো ধানের চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন গ্রামীণ কৃষকরা। মাছের ঘেরে বোরো ধানের চাষ করে অধিক ফলন পাচ্ছেন তারা। ফলে খাদ্য ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি আর্থিক স্বচ্ছলতায় ফিরছে কৃষক পরিবারে।
দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা পূরণের পর মিঠা পানির মাছের ঘেরে বোরো চাষে গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক জনগোষ্ঠীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। একই সাথে খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকার আসছেন তারা। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ঘেরের মাছ ধরার পর পানি শুকিয়ে সেখানে পুনরায় মাছ চাষের পরিবর্তে কৃষকরা চাষ করছেন বোরা ধান। গত কয়েক বছর ধরে এই ধরনের চাষ পদ্ধতিতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। ফলে ক্রমশঃ বাড়ছে এই চাষ পদ্ধতি।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, মাছের ঘেরে ধানের ফলন হয় অন্য জমির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। এখানে বোরো ধান লাগাতে বাড়তি কোন চাষের প্রয়োজন হয় না। খরচও অনেক কম। যে কারণে বোরো মৌসুমে মাছের চেয়ে ধান চাষের লাভের সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। ফলে বর্ষা মৌসুমের পর মিঠা পানি শুকিয়ে গেলে মাছের ঘেরে ধান চাষ করছেন কৃষকরা। আবার অনেক কৃষক বর্ষা মৌসুমে চাষ করা মাছ ধরে নিয়ে নিজেরা ঘেরের পানি সরিয়ে জমি শুকিয়ে বোরো ধান চাষ করছেন। কয়েক বছর যাবত মাছের ঘেরে বোরো ধান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন সাতক্ষীরার গ্রামীণ কৃষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভোমরা এলাকার দাঁতভাঙ্গা ও শালতিয়া বিল, দক্ষিণ হাড়দ্দহার বিল চৌবাড়িয়া ও গয়েশপুর বিল পদ্মশাখরা বিল ঝাউডাঙ্গা এলাকার উত্তর বিল, দেবনগরের কচুর বিল এবং তালা উপজেলার জেঠুয়া মাঠ ও নগরঘাটা বিলের বিভিন্ন মাছের ঘেরে বোরো চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে চাষের জমির পাশাপাশি মাছের ঘেরে বোরো ধানের চারা রোপন করছেন কৃষকরা। তারা বলছিলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চারা উৎপাদনও ভালো হয়েছে এবার। সব কিছু ঠিক থাকলে ভালো ফলনের আশা করছেন কৃষকরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছেন, জেলার সাত উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় নিচু জমিতে গড়ে উঠেছে মিঠা পানিতে সাদা মাছের ঘের। বর্ষাকালীন সময়ে এসব ঘেরে চাষ হয় সাদা মাছের। নভেম্বর-ডিসেম্বরে ঘেরের মাছ উঠিয়ে সেখানে বোরো ধানের আবাদ করা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, জেলায় এবার ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে তালা উপজেলা সদরের ৩০০ একর জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে ট্রেতে বীজ বপন ও মেশিনে পাতার রোপণের মাধ্যমে হাইব্রিড, তেজ গোল্ড জাতের বোরো ধানের চাষাবাদ হচ্ছে। ফলে ধানের উৎপাদন শতভাগ অর্জিত হবে বলে আশা করছেন কৃষকসহ কৃষি কর্মকর্তারা।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মনির হোসেন জানান, অল্প জমিতে বেশি ধান উৎপাদন করে মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সাতক্ষীরায় উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে সমলয় পদ্ধতিতে বোরোর চাষাবাদ শুরু হয়েছে। ফলন বাড়াতে সমলয় পদ্ধতিতে যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। সাতক্ষীরার মাধবকাটি বলাডাঙ্গা বিলে সম্প্রতি এ আবাদ কার্যক্রম শুরু করা হয়। নতুন এই পদ্ধতিতে চাষাবাদের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকার ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তাহমিনা খাতুন জানান, ধান গাছের অবশিষ্ট অংশ ও সবজির উচ্ছিষ্ট পচনের ফলে জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেন ও ফসফরাস জাতীয় জৈব উৎপন্ন হয়, যা ঘেরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। মাছের খাবারের উচ্ছিষ্ট ও মলমূত্র তলদেশে জমা হয়। তলদেশের জৈব উপাদান সমৃদ্ধ মাটি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ধান ও সবজি চাষ করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। কৃষি নির্ভর উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের পাশাপাশি বোরো চাষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান, জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১,৬৯,৩৩৯ হেক্টর। অনাবাদি জমি রয়েছে ৫৮৬৭১ হেক্টর। এই জমিতে কোন ফসল হচ্ছে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক গৃহীত সাতক্ষীরা জেলায় জমির সদ্ব্যবহারের নিমিত্তে করণীয় বিষয়ক প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হলে আরো ১৯, ৯৪২ হেক্টর জমি আবাদের আওতায় আসবে।
তিনি আরও বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে বেশি জমিতে বোরো আবাদ হতে চলেছে। এছাড়া প্রতিটি উপজেলায় জলবায়ুর ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করে কৃষি, খাদ্য ও অবকাঠামোসহ সব বিষয় নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মৎস্য ঘেরে বোরোর আবাদ উৎপাদনে কৃষি খামারবাড়ি কাজ করে যাচ্ছে।
খুলনা গেজেট/এনএম